আজকের গল্পঃ পেরেকের স্যুপ

পেরেকের স্যুপ: একটি সুইডিশ লোক কাহিনী (হার্ভ জেমাচ, ফোলেট পাবলিশিং, শিকাগো, 1964 দ্বারা লিখিত করা)

একবার এক বনের মধ্যে দিয়ে ট্র‍্যাম্প নামের একজন লোক হেঁটে যাচ্ছিলো। লোকটা অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পরেও কোন বাড়িঘরের খোঁজ পায় নি, আর সে কোথায় আশ্রয় পাবেন এই সময় তা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলো । সে মনে মনে ভাবতে লাগলো আহা! কতই না ভালো হতো যদি আগুনের গরম হাওয়া আর রাতের খাবার পেটে জুঁটতো। কিন্তু সুর্য ডুবে যাচ্ছিলো আর আশেপাশে কোথাও কুটির দেখা যাচ্ছিলো না।

ঠিক সেই সময়ে ওই লোকটি একজন বৃদ্ধার সন্ধান পেলেন যিনি কিনা আগুন জ্বালবার জন্য খড়কুটো জোগাড় করছিলেন। ট্র‍্যাম্প বুড়ির কাছে গিয়ে খুশী টগবগে হয়ে বললো, " জ্বী শুনছেন, কেমন আছেন?"

বুড়িটি বললো" এইতো আছি কোনরকম,তো বাছা তুমি কোথা হতে এসেছো।"

ট্র‍্যাম্প জবাব দিলো "এখানে এবং সেখানে, দূরে এবং কাছাকাছি,আমি পৃথিবীতে বাস করি, এই পৃথিবীটাই আমার বাড়ি।"

বুড়ি বললো " তাই নাকি, তো তুমি এখানে এসেছো কিসের জন্য?

সে জবাব দিলো, " আমি আসলে রাতে আশ্রয়ের জন্য একটা জায়গা খুঁজছিলাম আরকি!"

বুড়িটি বললো " ঠিক এটাই আমি আন্দাজ করেছিলাম, অন্য কোথাও গিয়ে খোঁজ করো, আমি বাঁড়িটা কোন মেহমানখানা না।"

ট্র‍্যাম্প বললো "হে বুড়ি, এতো কঠোর হৃদয় আর মমতাহীন হওয়া ঠিক না। আমরা মানুষ হিসেবে একে অপরকে সর্বদা সাহায্য করা উচিৎ।"

বুড়ি বললো, " একে অপরকে সাহায্য করা? রসিকতা করছো নাকি? আমাকে এখানে কয়জন লোক সাহায্য করতে আসে?

কিন্তু ট্র‍্যাম্পও দমে যাবার পাত্র নয়। বুড়িটি একের পর এক অসুবিধা বলতে থাকলো, আর ট্র‍্যাম্পও পালটা যুক্তি-তর্ক চালাতে থাকলো, শেষ পর্যন্ত না পেরে বুড়ি বললো সে থাকতে চাইলে তাকে মেঝেতে ঘুমোতে হবে।

বুড়ির উদারতার জন্য সে তাকে ধন্যবাদ জানালো আর বললো. "দরজার বাইরে কনকনে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার চেয়ে শক্ত মেঝের উষ্ণতাই ভালো।" তবে ট্র‍্যাম্প এর একটা বিশেষ গুণ এই ছিলো যে সে সবসময় সব সমস্যার সমাধানের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতো।

ঘরের ভিতর ঢুকেই সে বুঝতে পারলো বুড়িটা ততটাক গরীব নয় যতটা সে দেখায়,বুড়ি গরীব না হলেও বেশ কৃপণ স্বভাবের।

তাই সে সর্বাত্মক ভদ্রভাবে বললো তাকে যেন কিছু খেতে দেওয়া হয়।

বুড়িটি বললো, " তুমি কিভাবে ভাবতে পারলে যে আমি তোমাকে কিছু খেতে দেবো? যখন কি না আমার পেটেই কোন খাবার জুটে না?"

ট্র‍্যাম্প ভালোভাবেই জানতো তাকে এখন কি করতে হবে। সে বললো," বলেন কি বুড়ি! আপনি সারাদিন কিছুই খান নি! হায়রে অসহায় বুড়ি, আপনার নিশ্চয় খুব খিদা পেয়েছে! আমাকে একটা পাত্র ধার দিন, আমি আমাদের দুজনের জন্য রাতের খাবার বানাবো।"

বুড়িটি অবাক হয়ে বললো, " রাতের খাবার বানাবে? যেখানে খাওয়ার কিছুই নেই সেখানেই তুমি রাতের খাবার কিভাবে বানাবে?"

ট্র‍্যাম্প বললো, " এটা আমার উপর ছেড়ে দিন, আমি দুনিয়া ঘুরে ঘুরে এমন কিছু জিনিস শিখেছি যা বেশীরভাগ লোকই জানে না।"

বুড়ি অবাক হয়ে ভাবলো সে আসলে কি বানাতে যাচ্ছে, তাই বুড়ি তাকে একটা পাত্র দিলো।"

সে পাত্রে কিছু পানি ঢাললো আর আগুনের উপর বসিয়ে দিলো, আর তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ফুঁ দিয়ে আগুনের তেঁজ আরো বাঁড়িয়ে দিলো। তারপর সে তার পকেট থেকে একটি সাধারণ পেরেক নিয়ে হাতের তালুতে সেট করে তিনবার ঘুরিয়ে পাত্রে ফেলে দিল।

বুড়িটি দিলো সে পেরেকটি পাত্রের নিচে ডুবে যাচ্ছে বুড়ি এসব দেখে বললো, " এটা কি হতে যাচ্ছে?"

ট্র‍্যাম্প জবাবে বললো, " এটা পেরেকের স্যুপ।" এরপর সে কাঠি দিয়ে পানিটাকে নাড়তে লাগলো।

বুড়িটি বললো, " পেরেকের স্যুপ"

ট্র‍্যাম্প বললো, " ঠিক বলেছেন, এটা পেরেকের স্যুপ"

বুড়ি ভেবেছিলো সে তার জীবনের পুরো সময়ে এমন কিছু নেই যা সে দেখে নি বা জানে না, কিন্তু পেরেকের স্যুপ সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিলো না।

ট্র‍্যাম্প বললো, " যদি আপনি এটা শিখতে চাও, তাহলে দেখতে থাকুন। এটা শিখতে পারলে আপনাকে আর পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে হবে না।" সে স্যুপ নাড়তে লাগলো আর বুড়ি খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখছিলো।

সে বললো, ", "আপনি জানেন, আমি এক সপ্তাহের বেশী সময় ধরে এই একই পেরেক দিয়ে স্যুপ বানিয়ে যাচ্ছি, তাই আমাদের স্যুপটা কিছুটা পাতলা হতে পারে ৷ অবশ্য একটু ময়দা আর জইচূর্ণ হলে মন্দ হতো না, তাহলে আমরা একটু ভালো খাবার পেতাম আরকি। কিন্তু,এসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে না। আমরা এগুলা ছাড়াও রান্না করতে পারবো, কোন অসুবিধা হবে না।"

বুঁড়ি বললো, " দাঁড়াও, আমার কাছে হয়তো কিছু ময়দা আছে। বুঁড়ি ময়দা আনতে গিয়েছিলো আর আনার পর দেখা যায় সেটা খুব ভালো মানের ময়দা।

ট্র‍্যাম্প স্যুপের মধ্যে ময়লা ছিটিয়ে তা মাখতে থাকলো, বুঁড়িটি একবার পাত্রের দিকে তাঁকায়, একবার তার দিকে তাকায়, আবার পাত্রের দিকে তাঁকায়।"

সে বললো "প্রায়ই হয়ে আসছে, কোন এক রেঁস্তোরায় এরকম খাবার পরিবেশন করা যাবে আহা। কিছু আলু আর লবণাক্ত গরুর মাংস যোগ করলে এটা একদম ভদ্রলোকের খাবার হয়ে যেতো। কিন্তু এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করলে তো আর হবে না আমাদের এসব ছাড়াই ভাবতে হবে, আর এই সম্পর্কে দ্বিতীয়বার কোন কথা মুখ দিয়ে বের করা যাবে না।"

বুঁড়ি কিছুক্ষণ ভাবলো ভাবার পর বললো সে কিছুক্ষণ খুঁজলে আলু আর গরুর মাংস জোগাড় করতে পারবে। এরপর বুঁড়ি সেগুলো বের করে ট্র‍্যাম্পের হাতে দিলো আর ট্র‍্যাম্প সেগুলো কেঁটে পাত্রে দিয়ে নাড়াতে থাকলো।

সে বললো, " এটা একটা দুর্দান্ত স্যুপ হবে। এই দারুন মজাদার স্যুপের মজা সবাই নিতে পারবে না।"

বুঁড়ি বললো, এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার! এমন একটা স্যুপ তৈরী হয়েছে শুধুমাত্র একটা পেরেক থেকে!"

ট্র‍্যাম্প বললো, " আরেকটু বাকী আছে আছে আর তা হলো সামান্য যব আর কিছু ফোঁটা দুধ হলেই হয়। এমনটা হলে আমরা রাজাকেও আমাদের খাবার খাওয়াতে আমন্ত্রণ জানাতে পারি, রাজা তো রোজ সন্ধ্যায় এটাই খায়, তার বাবুর্চী তো আমাকে তাই বলে।"

বুঁড়ি বললো "বলো কি! রাজা নিজেই!" বুঁড়ি তো আনন্দে আত্মহারা, খুশীতে একেবারে ডগমগ অবস্থা।

ট্র‍্যাম্প বললো, " কিন্তু কি আর করার, আমাদের এগুলো ছাড়াই রাঁধতে হবে, আর এ নিয়ে দ্বিতীয়বার কোন কথা বলা যাবে না।"

বুঁড়ি দেখতে গেলো তার ঘরে এগুলো পাওয়া যায় কি না সে দেখলো তার ঘরে প্রয়োজনমতো যব এবং দুধও ছিল। ট্র‍্যাম্প সেগুলো নিয়ে ঘাঁটতে থাকলো, ঘাঁটতে থাকলো আর ঘাঁটতে থাকলো। তারপর সে হঠাৎ করে থেমে গেলো এবং সে ফুঁটন্ত পাত্র থেকে পেরেকটি উঠিয়ে নিলো ।

সে বললো, " এটি তৈরী, আমরা এখন রাজা ও রানীর মতো ভোজ করবো। অবশ্য, যখন তারা এই ধরনের স্যুপ খায়, তখন তাদের সাথে সবসময় একটি স্যান্ডউইচ এবং কমলার শরবত থাকে। এবং টেবিলে একটি টেবিলক্লথ। কিন্তু আমাদের এসব লাগবে না। এসব নিয়ে আর দ্বিতীয়বার কথা হবে না।

এবার বুঁড়ি নিজেকে বেশ শাহী ঘরানার ভাবতে লাগলো। বুঁড়ি ভেবেছিলো, বেশ যদি রাজা রানীরা এভাবে পরিবেশ করতে পারে তাহলে সে আর ট্র‍্যাম্পও এভাবে করতে পারবে। সে তাড়াতাড়ি আলমারির কাছে গিয়ে কমলার শরবত, গ্লাস, পনির, মাখন, ধোঁয়াদার গরুর মাংস এবং বাছুরের ছোট মাংস বের করল। টেবিলের পক্ষে এতো কিছুর ওজন ধরে রাখা সম্ভব ছিলো না।

সেই বুড়ির এতো ভালো সময় তার জীবনে কখনো আসে নি , এবং বুড়ি এতো রাজকীয় স্যুপ কখনো পান করে নি --এবং সবচেয়ে মজার কথা এই যে এটা এতোকিছু একটা পেরেক দিয়ে আরম্ভ হয়েছে ! তারা খেয়েছে, পান করেছে, এবং আনন্দে তারা নেঁচেছিলো , তারপর তারা আরো কিছু খেয়েছিলো আর পান করেছিলো। এবং অবশেষে তারা যখন ঘুমাতে যাচ্ছিলো, আর ট্র‍্যাম্প তখন মেঝেতে শোয়ার জন্য যাচ্ছিলো, তখন বুড়ি বললো, " না না, এমন একজন ব্যাক্তির মেঝেতে শোয়া ঠিক না, তার বিছানায় শোয়া উচিৎ।"

ট্র‍্যাম্প বললো "এটা একটা আনন্দদায়ক ঈদের দিনের মতো ছিলো" "আমার সমস্ত ভ্রমণে আমি কখনো এমন চমৎকার মহিলার সাথে সাক্ষাৎ করি নি।" এর সে বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলে বুঁড়ি তাকে এক কাপ কফি আর একটা বান দিলো। এবং তিনি বিদায় জানানোর আগে, তাকে একটা উজ্জ্বল রৌপ্যের টুকরো দিয়েছিলেন" এবং বলেছিলো যে, " কিভাবে পেরেক দিয়ে স্যুপ বানাতে হয় তা শেখানোর জন্য তোমায় ধন্যবাদ," বুড়ি আরো বলেছিলো, "কারণ আমি জানি পেরেকের স্যুপ কীভাবে হয়, আমি এখন আরামে থাকতে পারবো ।"

ট্র‍্যাম্প বললো " ঠিক আছে,এটি আরো সহজ হবে যখন আপনি এটাতে আরো নতুন কিছু যোগ করবেন।

এরপর ট্র‍্যাম্প চলে যেতে থাকলো আর বুড়ি দরজার হতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো আর বললো "এ ধরনের মানুষ গাছে জন্মায় না।"

মন্তব্যসমূহ